ভূগোল সম্পর্কে জানি (পর্ব-২)
ভূগোল সম্পর্কে জানি (পর্ব-২)
জাহিদুল ইসলাম
ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অনেক কথা হলো এবার আমাদের প্রাণের দেশ "সোনার বাংলাদেশের" প্রসঙ্গে আসি ।। বাংলাদেশে আমরা জানি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ।। এই বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ।। এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পূর্বে বাংলাদেশের সকল স্নাতক কলেজ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলো, যেমনঃ রংপুরের কারমাইকেল কলেজ, কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ, বরিশালের বি এম কলেজ, রাজশাহী কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা কলেজ ইত্যাদি ।। ঐ সময় এই কলেজ গুলোর শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতো ভারতের "কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়" সে সময়ে ।। সে সময়ে এই অঞ্চলের ভূগোল শিক্ষার শেকড় ছিলো কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ।। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও ভূগোল পড়ানো হতো , আবার পুরনো কলেজ, যে গুলো বর্তমান বাংলাদেশে অবস্থিত ছিলো সেগুলোর অনেকগুলোতে ভূগোল সাবজেক্ট টি ছিলো ।। এর মধ্যে রাজশাহী কলেজ, ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজের নাম উল্লেখ করা যায় ।। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে এগুলো পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরে ।।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৯ সালে ।। সেটি ছিলো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রথম বাংলাদেশে ভূগোলের পাঠদান ।। এরপর ১৯৫৫ সালে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় ।। পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭০ সালে স্থাপিত হবার সময়ই প্রতিষ্ঠাকালীন বিভাগ হিসেবে ঐ বছরই জাহাঙ্গীরনগরে ভূগোলের যাত্রা শুরু হয় ।। বলা বাহুল্য তৎকালীন জগন্নাত্থ কলেজ বর্তমানে "জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে" রুপ নেয়ায় সেখানেও ভূগোলের অবস্থান রয়ে যায় , কেননা কলেজ থাকাকালীনই সেখানে ভূগোল ছিলো ।। বাংলাদেশের দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় "চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে" ভূগোল বিভাগ অনেক পরে ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ।। এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুরেও ভূগোল চালু হয় ।। সিলেটের শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ভূগোল বিভাগ স্থাপন করে ।। সর্বশেষ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ভূগোল চালু করে ।। দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মধ্যে একমাত্র Central Women's University, Dhaka তে ভূগোল রয়েছে ।। ভূগোলকে কেন্দ্র করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণ পৃথক একটি অনুষদ গড়ে তুলেছে ।। যা হলোঃ"Faculty of Earth & Environmental Sciences"; যেখানে ভূগোল বিভাগ ছাড়াও ভূগোলের আরও ৩ টি অঙ্গ বিভাগ রয়েছে ।। এগুলো হলোঃ সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ; ভূতত্ত্ব বিভাগ ; দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ ।।
তারমানে দেশের বড় ও প্রথম সারীর বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর সবকটিতে ভূগোল বিভাগ আছে ।। কেন আছে ?? এর প্রয়োজনীয়তার কথা মাথাই রেখেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সমূহ এই বিভাগটি খুলেছে ।। এবার বলি, বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যায়ে একটা ভুল ধারণা আছে ।। সেটা হলো ভূগোল আর্টসের সাবজেক্ট ! এটা কিন্তু একটা গুজব ।। আসলে ভূগোল একটা প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বা Natural Science. ভূগোলে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন , জীব বিজ্ঞান, পরিসংখ্যান, গণিত সকল বিষয়ই পড়ানো হয় ।। এবার বলুন, তাহলে এটা আর্টসের সাবজেক্ট হয় কিভাবে ?? প্রথমে কিন্তু বলা হয়েছে "ভূগোল বিজ্ঞানের জননী" ।। কেন ? তাও বলা হয়েছে ।। তাহলে শিওর হয়ে নিন যে, ভূগোল একটি বিজ্ঞান ।। এটা আর্টস বা কলা নয় ।। আমাদের বাংলাদেশে ভূগোল বিষয়টি আর্টসের সাবজেক্ট হিসেবে গুজব ছড়ানোর একটা কারন আছে, সেটি হলো স্কুল বা মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ে বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এই ভূগোল সাবজেক্ট টি সাইন্স তো বটেই এমনকি আর্টস আবার কমার্স এর ছাত্র - ছাত্রীরাও নিতে পারে ।। আবার কমার্সে "বাণিজ্যিক ভূগোল" পড়ানো হয় ।। আর অর্থনীতিতে স্নাতক পড়তে গেলেও "অর্থনীতিক ভূগোল" পড়তে হয় ।। মূলত এই কারনে সবার মধ্যে এখনও একটা ভুল ধারণা প্রচলিত, যে ভূগোল আর্টস !! ভূগোল কিন্তু আর্টস না পিউর সাইন্স ।।
দেখেন এই আর্টিকেলে আগে বলা হয়েছে, আবারো বলছি যে, ভূগোল একটি বিজ্ঞান যা মূলত প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এটা সামাজিক বিজ্ঞান ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এর মধ্যে সেতু স্বরূপ ।। মানুষ,পরিবেশ,পৃথিবী এবং এর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক , কাঠামো , ক্রিয়া ইত্যাদি আলোচনা করাই এর কাজ ।। তাই কমার্সে "বাণিজ্যিক ভূগোল" পড়ানো হয়, অর্থনীতিতে "অর্থনৈতিক ভূগোল" পড়ানো হয় কেননা ভূগোল সামাজিক বিজ্ঞান ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এর মধ্যে সেতু স্বরূপ।।
এবার একটা সাধারণ উদাহরণ দিয়ে পুরো বিষয়টি পরিষ্কার করি,
আলোচনায় বল্লাম, অনেকে মনে করে ভূগোল আর্টস ! যা আসলে একটা ভ্রান্ত ধারণা ।। কেন মনে করে ভূগোল আর্টস ?? ঐ যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে আর্টস ও কমার্সের ছাত্র ছাত্রীরা ভূগোল নেয় ।। যদি এটা সাইন্স হতো, তবে তারা তো এটা নিতে পারতোনা ।। কথায় যুক্তি আছে ।। কিন্তু ভূগোল কি সেটা বার বার বলেছি ।। এটাও বলেছি যে, ভূগোল বিজ্ঞান হওয়া সত্ত্বেও কেন আর্টস বা কমার্সের স্টুডেন্টরা মাধ্যমিক অথবা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এটা নিতে পারে ।। ঐ যে এটা "সামাজিক বিজ্ঞান ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এর মধ্যে সেতু স্বরূপ।"
এখন ভূগোল ব্যাতিত অন্য আরও দুইটি শাস্ত্রের উদাহরণ দেই , যেগুলো বিজ্ঞান হবার পরেও ঐ মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ওইগুলোও আর্টস এবং কমার্সের স্টুডেন্টরা নিতে পারে ।। এইরকম দুইটি সাবজেক্টঃ ১] কৃষি শিক্ষা ও ২] কম্পিউটার শিক্ষা !!
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এই কম্পিউটার শিক্ষা ও কৃষি শিক্ষা আর্টস / কমার্স / সাইন্স সবাই নিতে পারে, তা আমরা সবাই জানি ।।
কিন্তু এই কৃষিতে কিংবা কম্পিউটার বিজ্ঞানে অনার্স /মাস্টার্স করতে গেলে সেটা কিন্তু আর আর্টস কিংবা কমার্সের স্টুডেন্টরা করতে পারেনা কেননা ওইগুলো BSc(Honours) বা Bachelor of Science(Honours) ।। আর্টস বা কমার্সের কারো Science background না থাকার কারনে তারা কিন্তু মাধ্যমিক / উচ্চ মাধ্যমিকে ঐ বিষয় দুইটি অধ্যয়ন করতে পারলেও অনার্স মাস্টার্স করতে পারছেনা ।। কোন "কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়" কিংবা কোন "প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়" অথবা কোন "বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়" তাঁদের এই সুযোগ দেয়না ।। ঠিক তেমনই ভূগোল মাধমিক/উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সবাই নিতে পারলেও অনার্স পর্যায়ে ঐ কম্পিউটার বিজ্ঞান কিংবা কৃষির মতোই অর্থাৎ "BSc(Honours) বা Bachelor of Science(Honours)"।।
উপরে বাংলাদেশের যতোগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলেছি সেগুলোর কেউই ভূগোলে BA কিংবা BSS ডিগ্রি দেয়না ।। সবগুলোই BSc(Honours) ডিগ্রি দেয় ।। এবার বুঝলেন তো ?? সাইন্স না হলে বাংলাদেশের এইসব বিশ্ববিদ্যালয় কেন ভূগোলে অনার্স পর্যায়ে BSc(Honours) ডিগ্রি ও মাস্টার্সে MSc ডিগ্রি দিতো ?? শুধু কি বাংলাদেশ ??
ঐ যে বলেছিলাম "অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের" কথা, যেটা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভূগোল শিক্ষার পীঠস্থান ! ওইখানেও এটা সাইন্স ।। ওইখানেও ভূগোলে অনার্স পর্যায়ে BSc(Honours) ডিগ্রি ও মাস্টার্সে MSc ডিগ্রি দেয় ।।
ভূগোল অনার্স পড়তে গেলে একজন ছাত্রকে বিজ্ঞানের সকল বিষয়াদির সাথে সম্পৃক্ত থাকতে হয় ।। এখানে প্র্যাকটিকেল করতে হয় , ল্যাব করতে হয় ।। যেমনঃ Environment Lab, Weather Lab, GIS(Geographic Info System) Lab, Hydro-logical Lab ! ফিল্ড ওয়ার্ক করতে হয় ।। প্রোজেক্ট করতে হয়, প্রেজেন্টেশন করতে হয়, রিসার্চ পেপার জমা দিতে হয় ! নিয়মিত Assignment Paper জমা দিতে হয় ।।
আছে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর মতো অনেক Cartographic Drawing, Project Drawing, Settlement Drawing, Spatial Drawing প্রভৃতি বিষয়গুলো ।। এখন কি মনে হচ্ছে যে এটা সাইন্স ?? জি হ্যাঁ সাইন্স তো বটেই ।। শুধু সাইন্স নয় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং , পদার্থ বিজ্ঞান, অঞ্চল পরিকল্পনা, আবহাওয়া গবেষণা, ভূতত্ত্ব, পানি সম্পদ উন্নয়ন, পরিবেশ উন্নয়নের মতো জটিল জটিল বিষয়াদি এখানে সন্নিবেশিত আছে ।।
এই গুলো কারনেই এই সাবজেক্টের চাহিদা অ্যামেরিকায় আকাশচুম্বী !!
কারন অ্যামেরিকানরা পরিবেশ বা পৃথিবীকে অন্য কোন দেশের চেয়েও বেশী নিয়ন্ত্রণ করতে চায় ।।


No comments